একটা কথা আজকাল শোনা যায়, ‘আমাদের গল্পে আমাদের সিনেমা’। আপনার সিনেমাগুলো কতখানি আমাদের সিনেমা?
আমার প্রথম ফিল্ম গেরিলা’, ওটা ১৯৭১ সালের গল্প। একান্তই আমাদের গল্প। তারপর ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’, এটা ঢাকা শহরেরই গল্প। ‘পায়ের তলা মাটি নাই’ একান্তই আমাদের সিনেমা। কাজ করেছি ‘গুণিন’-এ, এটাও হাসান আজিজুল হকের গল্প। আমাদেরই গল্প এটা। রুবাইয়েত হোসেনের ‘শিমু’, এটাও আমাদের গল্প। নাম শুনলেই বোঝা যায় গল্পগুলো আমাদেরই। যেমন, ‘ইতি তোমার ঢাকা’। গল্প আলাদা করে বলার দরকার নেই। টাইটেল শুনেই বোঝা যায় এগুলো আমাদের গল্প।
আপনি অনেক বছর ধরে অভিনয় করছেন। অথচ ইদানিং গণমাধ্যমে আপনার নামটি ঘন ঘন আসছে। আপনি কি প্রচারবিমুখ অভিনেতা নাকি আপনিই ইদানিং নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন?
প্রচারমুখীও না, প্রচারবিমুখও না। এখন প্রচার পাওয়ার কারণ হচ্ছে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া। ভালো কাজ বা কিছু হলে এমনিতেই প্রচার হয়। তাছাড়া আমার অ্যাক্টিং করার এপ্রোচের মধ্যেও চেঞ্জ এসেছে। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ থেকে আমার কনসেনট্রেশন চেঞ্জ হয়েছে। ক্যারেক্টার বাছাই করার ব্যাপারে অনেক কনশাস হয়েছি। যে কারণে ভালো গল্প, চরিত্র, এফোর্টÑ তিনটাই চেঞ্জ হয়েছো, তাই হয়তো কাজগুলো চোখে পড়ছে।
সব অভিনেতার জীবনেই একটা টার্নিং পয়েন্ট বলা হয়। আপনার ক্যারিয়ারে ‘মি. জনি’-ই কি সেই টার্নিং পয়েন্ট?
আমার টার্নিং পয়েন্ট বলতে গেলে আমি বলব ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র কথা। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র দুয়েক বছরের মধ্যে ‘মি. জনি’ করি। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র স্ক্রিপ্টটা যখন আমি পাই, তখনই আমার মনে হয় যে চরিত্রটার অনেকগুলো শেড আছে, চরিত্রটার বিভিন্ন ইনার কনফ্লিক্ট আছে, এগুলো পড়ে আমি খুব উত্তেজিত হই। তখন আমার বোধোদয় হয় যে, গত অনেক বছর ধরেই অভিনয় করছি, কিন্তু চরিত্রগুলোর প্রতি আমি সুবিচার করতে পারছি কি না। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’তে আমি খুব সচেতন ছিলাম যে, আকর্ষণীয় একটা চরিত্র পেয়েছি, পরে কখনো যেন আফসোস না হয় যে এত জোশ একটা চরিত্র পেয়েছি, কিন্তু আমি করি নাই। ওখান থেকেই সিদ্ধান্ত নেই যে ধরে নেব যে এটাই আমার শেষ অভিনয়। এতে আমি এই পরিমাণ এফোর্ট দেব যেন পরে আমি রিগ্রেট না করি। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র পর থেকেই এই এপ্রোচে কাজ করা শুরু করি। ২০১৫ সালে আমরা ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ শুট করি, ২০১৬ সালে এটা সিঙ্গাপুর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যায়। বাংলাদেশের মানুষ এটা দেখেছে ২০১৯-এ। দর্শকরা ‘মি জনি’ দেখেছে আগে।
একটা চরিত্রকে ধারণ করার জন্য আপনার কী রকম প্রস্তুতি থাকে? শুনেছি, ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র জন্য আপনি নাকি সবসময় ক্র্যাচে ভর করে হাঁটতেন?
এটা ডিপেন্ড করে আসলে। একেকটা চরিত্রের জন্য প্রিপারেশন একেকরকম হয়। আমার যে অবস্থান আর চরিত্রটার যে অবস্থান, দুটোর দূরত্বের ওপরে নির্ভর করে কতখানি এফোর্ট আমাকে ওই চরিত্রটার জন্য দিতে হবেÑফিজিক্যালি, মেন্টালি, সাইকোলজিক্যালি। কিছু ক্ষেত্রে মেন্টাল ডিসটেন্স অনেক বেশি। কিছু জায়গায় ফিজিক্যাল ডিসটেন্স অনেক বেশি। যেখানে দূরত্ব বেশি হয়, সেখানে তত কাজ করা লাগে। যেখানে দূরত্ব কম, সেখানে কাজ কম করতে হয়। যে জায়গায় দূরত্ব বেশি ওই জায়গায় কাজ করতে হয়। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’-তে ক্র্যাচ নিয়ে হেঁটেছি, কারণ আমার যে প্রপসটা ওটার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য, যেন মাথার মধ্যে অলওয়েজ থাকে যে এই ক্যারেকটারটা আমি করছি। এটা নিয়ে কোনো সমঝোাতা করা যাবে না। প্রতি স্টেপেই আমার মাথায় ছিল এই চরিত্রটা। এই ক্র্যাচটা যতটা না আমাকে ফিজিক্যালি হেল্প করেছে, তারচেয়ে বেশি হেল্প করেছে মেন্টালি। আমি সাইকোলজিক্যালি অনেক কাজ করি ক্যারেক্টার নিয়ে। চরিত্রের আইডোলজি কী, ও কী ধরনের ভেল্যুজ নিয়ে বড় হয়েছে, ওর পৃথিবীকে দেখার ভঙ্গিটা কী, ওর কাছে কোনটা রাইট কোনটা রং। কিংবা কীভাবে ও সবকিছু জাজ করে। আমি দিনের হয়তো দু তিন ঘন্টা ওই ক্যারেক্টারটা হয়ে থাকি। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র চরিত্রটা হচ্ছে সাজ্জাদ। হয়তো আমি কোথাও যাচ্ছি, জ্যামের মধ্যে বসে আছি, ধরে নেই যে আমি সাজ্জাদ। জ্যামে থাকলে আমি মনওয়ার আমার চিন্তাগুলো করি। কিন্তু তখন আধঘন্টা বা এক ঘন্টা আমি সাজ্জাদ হয়ে থাকি। সাজ্জাদ হয়ে গেলে ও কই যাচ্ছে, ওর গন্তব্য কী, ও নেক্সট কী করবে, ওর গার্লফ্রেন্ড রেহানাÑও ফোন দিবে কী দিবে না; সাজ্জাদের চিন্তাগুলো আমি করতে থাকি। এই চিন্তাগুলো করলে কিছুদিন পর নিজেকে ওই চরিত্রটা মনে হয়। শুটের আগে আমি নিজেকে কনফিডেন্টলি বলতে পারি যে আমি সাজ্জাদ। অতএব চরিত্রটায় খারাপ পারফরমেন্সের প্রশ্নই আসে না। নিজেকে আমি বুঝ দেই যে, আমিই এই চরিত্রটা। রবার্ট ডি নিরো এলেও এটা আমার চেয়ে ভালো করতে পারবে না। ডি নিরোর তো এটা অ্যাক্টিং করতে হবে, আমার তো অ্যাক্টিংয় করতে হবে না। ওই চরিত্রটাই তো আমি! নিজেকে বুঝ দেই যে ওই চরিত্রটাই আমি, আমাকে অ্যাক্টিং না করলেও চলবে।
ওয়েব সিরিজ নিয়ে কথা বলা যাক। ওয়েব সিরিজ কি আশীর্বাদ হয়ে এলো অভিনয় শিল্পীদের জন্য? বলা হচ্ছে, ওয়েব সিরিজে তারকার চেয়ে শিল্পীর প্রাধান্য বেশি।
প্রাধান্য পায় গল্প। গল্পকে ফুঁটিয়ে তোলার জন্য দরকার হয় ভালো অ্যাক্টর ও এক্সিকিউশন। ভালো গল্পটা তখনই ভালো হয় যখন গল্পটা ওয়েল এক্সিকিউটেড হয় বা বিশ্বাসযোগ্য হয়। বিশ্বাসয্যো হওয়ার একটা দায়িত্ব পালন করেন অ্যাক্টররা। গল্প যেহেতু প্রধান এখানে, তাই দর্শকদের কাছে হয়তো ম্যাটার করে না কে স্টার কে স্টার না। কে গল্পটার পারপাস সার্ভ করতে পারছে ওই জায়গা থেকে অ্যাক্টর নেয়া হয়। এই জায়গা থেকে আর্শীর্বাদ যে শুধু বাংলাদেশে না অনেক দেশেই যারা ভালো অ্যাক্টর, আগে যাদের কাজ দেখি নাই তাদের ওপরেও একধরনের আলো পড়ছে।
‘তারকা’ অভিধাটির প্রতি আপনার কোনো দুর্বলতা কিংবা বিরোধিতা আছে আপনার? শিল্পীর জন্য তারকা হওয়াটা আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?
একজন শিল্পী তারকাখ্যাতিকে কীভাবে ডিল করছেন তার ওপরে অনেককিছু নির্ভর করে। কারো কাছে এটা আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারে। তারকাখ্যাতি হচ্ছে একধরনের সীমাবদ্ধতা। তারকাখ্যাতি মানে অনেক মানুষের অনেক এক্সপেকটেশন।ওই এক্সপেকটশেনর রেসপন্স করতে গিয়ে ওরা চায় আমাকে এভাবে দেখুক এই জিনিষগুলো মানুষ কেয়ার করা শুরু করে। ওর এত ফ্যানবেজ ওদের মতো করতে গিয়ে যেটা হয় যে ট্র্যাপে পড়ে টাইপকাস্ট হয়ে যাওয়ায় ভয় থেকে যায়। আর তারকা না হলে আমাকে কাউকে স্যাটিফায়েড করতে হবে না। আমি নিজেকেই স্যাটিসফায়েড করতে চাই। পারসোনলি আমার মনে হচ্ছে আমি এই জায়গাটা এক্সপ্লোর করব, ওই ফ্রিডমটা তারকা না হলেই পাওয়া সম্ভব। আমি কারো এক্সপেকটেশন মেটানোর জন্য কাজ করছি না। আমি আসলে যেমনটা নিজে চাই তেমনটাই করছি। বাই ডিফোল্ট যদি এগুলো সবার পছন্দ হয় তবে এটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ অবস্থা। তারকাখ্যাতিও রইল, আমি আমার ফ্রিডমটা নিয়েও কাজ করছি।
মঞ্চ ও সিনেমার তফাৎটা মোটা দাগের। নাটকের সঙ্গে সিনেমার তফাৎ করতে গিয়ে অনেকেই হিমশিম খান। ওয়েব সিরিজ আসার পর আমরা যেন আরো সংকটে পড়েছি। অভিনেতা হিসেবে আপনি কিভাবে মাধ্যমগুলোকে আলাদা করেন?
২০০৫ সালে শেষ আমি থিয়েটার করেছি। থিয়েটার থেকে ক্যামেরায় চলে আসি তখন বেশ এবকটু সমস্যা হয়েছিল আমার। আমার অনেক সময় লেগেছে ছন্দে ফিরতে সময় লাগছে। থিয়েটার করে আসার কারণে লং শটে অনেক বেশি হাত পা ছুঁড়ি অনেক জোরে কথা বলি। টিভিতে কাজ করতে গিয়ে কতটুকু টোনডাউন করতে হয় ওটা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। থিয়েচটার এত চেনা জায়গা যে স্বচ্ছন্দ ছিলাম। কিন্তু ক্যামেরায় এসে স্বতস্ফূর্ততা ছিল না। একসময় ক্যামেরাটাও বুঝতে শুরু করি আমি। এই পরিবর্তনগুলো শুধু বাইরের বিষয়Ñকত জোরে কথা বলব কত কম জোরে কথা বলব। অ্যাক্টিংয়ের যেকোনো প্রিপারেশরনটা ইন্টারন্যাল। প্রস্তুতিটা সব মাধ্যমে একই রকম। তেলরং একরকম, জলরঙ একরকম; কিন্তু কী আমি আঁকতে চাই সেটাই আসল। আমি কোন জিনিষটা ফুঁটিয়ে তুলতে চাইÑএটাই হচ্ছে চিন্তার বিষয়।
একদিকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, আরেকদিকে তামিম মৃধা; সবার সঙ্গেই কাজ করেছেন, করছেন। নতুন প্রজন্ম কি পূর্বসুরিদের পতাকা বয়ে নিয়ে যেতে পারছে? অভিনেতা হিসেবে আপনার
ভাবনা কী?
আমার নতুনদের সঙ্গে কাজ করতে বেশি ভালো লাগে। পূর্বসুরিদের মধ্যে যাদের মধ্যে নতুনদের মতো ক্ষুধাটা আছে তাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। নতুনরা যখন কাজ করে তাদের নিজেকে প্রমাণ করার ব্যাপার থাকে। নতুনদের আলাদা উচ্ছ¡াস থাকে। যদি সরয়ার ফারুকী ভাইয়ের কথা বলি। ভেবেছিলাম এখন হয়তো কোনেকিছু তাকে এট্রাক্ট করবে না। অথচ কাজ করতে গিয়ে দেখলাম এতদিন কাজ করেও উনি এখনো এক্টাইট ফিল করেন। পুরনোদের মধ্যে যারা নতুনদের মতো আচরণ করেন তাদের সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগে। যারা নিজেকে আপডেট রাখেন তাদেরকে ভালো লাগে আমার।
নিজস্ব প্রতিবেদক


Most Popular
নিজেকেই স্যাটিসফায়েড করতে চাই
একটা কথা আজকাল শোনা যায়, ‘আমাদের গল্পে আমাদের স...
নিজেকেই স্যাটিসফায়েড করতে চাই
বাংলা চলচ্চিত্রের শুদ্ধ মানুষ

২০১৮ বিশ্বকাপে মেসি আর বর্তমান আর্জেন্টিনার মেসি এক নয়,
বিধ্বস্ত মেসিকে খুব কমই দেখ...