বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস অন্যতম । অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক হিসেবে খ্যাত ছহিউদ্দিন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর। তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। আপামর বাংলার কৃষক-শ্রমিকের বন্ধু।
মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাসের জন্ম ১৯২৩ সালে তৎকালীন নদীয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমায়। তেহট্ট জেলার লালবাজার গ্রামের মোহাম্মদ ইয়াকুব বিশ্বাস ও মোছা. সামসুননেছার কোল জুড়ে যখন ছহিউদ্দিনের জন্ম, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে এবং পুরো ভারতবর্ষে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষ জুড়ে বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠেছে। যে বিদ্রোহ দমাতে ব্রিটিশ শাসকদের নির্দয় আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে ভারতবাসী।
এমনই এক অস্থির সময়ে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন অন্য দশটা শিশু-কিশোরের মতো ছিলেন না। চুয়াডাঙ্গা জেলার ভিজে হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার আগেই তার মনে প্রবল রাজনৈতিক বোধ তৈরি হয়। তিনি বুঝতে শেখেন, ব্রিটিশ শাসন নানা কালা কানুনের মাধ্যমে কিভাবে এই দেশের কৃষক-শ্রমিকদের বঞ্চিত করছে। আর এই অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করার ভাবনায় নিজেকে তখনই প্রস্তুত করতে থাকেন তিনি।
রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে ভর্তির পর রাজনীতির প্রতি আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন। তুখোড় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দেশপ্রেম তাঁকে অল্প দিনের মধ্যেই নেতৃত্বে নিয়ে আসে। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহচার্যে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু তাঁর মধ্যে গভীর জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখেছিলেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা হিসেবে মেহেরপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির গোড়াপত্তন করেন। মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন মেহেরপুর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৮ সালে মেহেরপুর পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছহিউদ্দিন বিশ্বাস ১৯৬৯ সাল থেকে আমৃত্যু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
নির্লোভ, বিনয়ী ও জনদরদী মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন মানুষের অফুরান ভালোবাসা পেয়েছেন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনে তাঁর ভ‚মিকা ছিল দেশ ও দলের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ফলশ্রæতিতে ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালে জাতির ক্রান্তিকালেও ত্রাতার ভ‚মিকায় দেখা যায় মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাসকে। এ সময় তাঁরই নির্বাচনী এলাকা মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময়ে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরে ‘৩-সি’ কোম্পানির রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন এবং বোই ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট, ট্রেনিং, ক্যাম্প পরিচালনা এবং সংশ্লিষ্ট সাব-সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধে এক অনন্য সংগঠক ও পরিচালকের ভ‚মিকা পালন করেন তিনি। এ কারণে তাঁর অনুপস্থিতিতে যশোর সেনানিবাসে পাক হানাদার বাহিনীর সামরিক আদালতে মৃত্যুদÐ ঘোষণা করা হয়।
স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গঠনে মনোনিবেশ করেন মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন কুষ্টিয়া-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে মেহেরপুরের গভর্নর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
জাতির ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বেদনাদায়ক ১৫ আগস্টের পর যখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সংকটে পড়ে, তখনো মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে দলের পুনর্গঠন কার্যক্রম চালিয়ে যান। আর এ কারণে তাকে ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজন হতে হয়েছে। তাতে অবশ্য দমে যাননি অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন। ১৯৭৬-৭৭ সালে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠনে আব্দুল মালেক উকিল ও সৈয়দা জহুরা তাজউদ্দিনের সহযোদ্ধা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন তিনি। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলের হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মেহেরপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
অসাধারণ মানবিক গুণের এই রাজনীতিক ১৯৯০ সালের ২১ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তবে নতুন প্রজন্মের জন্য রেখে যান এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার।
মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস জাতির সূর্যসন্তান। তাঁর মতো বীর বাঙলি জাতির গর্ব। তাঁর এই বীরত্ব এবং দেশের প্রতি অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মৃত্যুর ৩২ বছর পর ২০২২ সালে তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সন্মাননা স্বাধীনতা পদকে ভ‚ষিত করা হয়।
মোহাম্মদ ছহিউদ্দিনের সুযোগ্য পুত্র ফরহাদ হোসেন বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। বাবার নীতি-আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়া ফরহাদ হোসেন তার নির্বাচনী এলাকা মেহেরপুর-১ এর গণমানুষের প্রিয় নেতায় পরিণত হতে বেশি সময় নেননি। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরহাদ হোসেন বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
ফরহাদ হোসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর বাবা মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাসের আদর্শ লালন করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দেশের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই দুই নেতার নীতি-আদর্শ ছড়িয়ে দিতে মনোযোগী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
জাহিদ সুলতান


Most Popular
নিজেকেই স্যাটিসফায়েড করতে চাই
একটা কথা আজকাল শোনা যায়, ‘আমাদের গল্পে আমাদের স...
নিজেকেই স্যাটিসফায়েড করতে চাই
বাংলা চলচ্চিত্রের শুদ্ধ মানুষ

২০১৮ বিশ্বকাপে মেসি আর বর্তমান আর্জেন্টিনার মেসি এক নয়,
বিধ্বস্ত মেসিকে খুব কমই দেখ...